সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৪

নাটোর সড়ক দূঘৃটনা ট্রাজেডীর সঙ্গে জড়িত হানিফ পরিবহনকে বাচানোর চেষ্টা

Be the first to comment!

নাটোর সড়ক দূঘৃটনা ট্রাজেডীর সঙ্গে জড়িত হানিফ পরিবহনকে বাচানোর চেষ্টা

নাটোরের বড়াইগ্রামে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ার কারণ হিসেবে হানিফ পরিবহনের যে বাসটিকে দায়ী করা হচ্ছে ঘটনার ২৩ দিন পেরিয়ে গেলেও সেটি চিহ্নিত হয়নি এখনো। এ ঘটনার তদন্ত  কমিটি তাদের দাখিল করা প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, কেয়া এবং অথৈই পরিবহন নামে   দুটি বাসের সংঘর্ষের পর সড়কে পড়ে থাকা আহত যাত্রীদের চাপা দিয়ে যায় হানিফ পরিবহনের একটি বাস। যে কারণে হতাহতের ঘটনা বেড়েছ্ েবলে তারা উল্লেখ করেন । মর্মান্তিক এ র্দূঘটনার পর কেয়া পরিবহনের চালককে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গ্রেফতার করা হলেও হানিফ পরিবহনের  বাসটিকে আজোও সনাক্ত করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন । মর্মান্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনার পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ,হানিফ পরিবহন কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতার আহ্বান জানালেও সাড়া দেয়নি তারা। পরিবহনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কথাও বলতে রাজি হয়নি।
গত ২০ অক্টোবর বিকেল সোয়া ৩টায় বড়াইগ্রামের রেজুর মোড় এলাকার বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে ঢাকা থেকে নাটোরগামী কেয়া পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে অথৈ পরিবহন নামে একটি লোকাল বাসের সংঘর্ষে নিহত হয় ৩৬ জন। দুর্ঘটনার পর সড়ক এবং আশপাশের এলাকায় মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। দুই বাসের সংঘর্ষের পর মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া আর এমন পরিণতি কেন হয়েছে তা নিয়ে নানা কথা উঠে সেদিনই। দুর্ঘটনার কারণ জানতে, ঘটনার দিনই তদন্ত কমিটি করে সরকার। আর ঘটনার তদন্তে  উঠে আসে দুর্ঘটনায় আহত যাত্রীদের হানিফ পরিবহনের একটি বাসের চাপা দিয়ে যাওয়ার খবর।
তদন্ত  কমিটি জানান, অথৈ পরিবহনের দুর্ঘটনাকবলিত বাসের ছাদে যাত্রী ছিল ৪০ জনের বেশি। দুই বাসে সংঘর্ষের পর সেই যাত্রীরা সড়কে পড়ে যায়, কেউ মারা যায়, বাকিরা হয় গুরুতর আহত। এ সময় বেপরোয়া গতিতে হানিফ পরিবহনের বাসটি তাদের চাপা দিয়ে চলে যায়। এতে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
ঘটনার ২৩ দিন পরও হানিফ পরিবহনের কোন বাস,কোচ নম্বর বা  কে চালক ছিল সেটি এতদিনেও  অজানা থাকায় তদন্ত কমিটির আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে  হানিফ পরিবহনকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে বলে  এমন অভিযোগও উঠেছে। তবে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষÑ বিআরটিএ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ওই গাড়ির বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অনুরোধ করেছে সংস্থাটি।
গত ২৩ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলন হানিফ পরিবহনের বাসটির বিষয়ে কথা বলেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও।  তিনি  ঘাতক ওই বাসটিকে  চিহ্নিত করতে সবার সহযোগিতাও চান। হানিফ পরিবহনের মালিকও সরকারকে সহায়তা করবেন এমন আশার কথাও বলেন মন্ত্রী। এর তিনদিন পর ২৬ অক্টোবর কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছে  বিআরটিএ কর্তপক্ষ ।  দেশের প্রতিষ্ঠিত হানিফ এন্টার প্রাইজের মতো কো¤পানির একটি বাস চিহ্নিত করা কি এতই কঠিন যে, সরকারকে রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সহযোগিতা চাইতে হবে? এ কথা মানতে নারাজ নিহতদের স্বজনরা। হানিফ পরিবহনের বাস পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে  আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যাবে , এ সময় কোন কোচ র্দূঘটনা এলাকা অতিক্রম করছিল । কারণ , প্রতিটি হানিফ গাড়ীর নির্ধারিত সময় রয়েছে ্ ।গাড়ির চালক কে ছিল ? সরকার র্দূঘটনার পর নিহত পরিবারগুলোকে এক লাখ টাকা করে প্রদান করে দায়িত্ব সেরেছে ।
দুর্ঘটনার দিনই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নাটোর জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) এবংবিআরটিএর একজন সহকারী পরিচালক এই তদন্ত  কমিটিতে ছিলেন। নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেই তাদেও লিখিত  প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে।গত ২৩ অক্টোবর তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পৌঁছায়। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই ঘটনায় প্রকৃত দোষী অথৈ পরিবহন, কেয়া পরিবহন, হানিফ পরিবহনের মালিক, চালক ও সহযোগীরা। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিআরটিএ তিন বাস মালিকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে।
তদন্ত  প্রতিবেদনে বলা হয়, কেয়া পরিবহনের চালক বেপরোয়াভাবে বাস চালাচ্ছিল। সড়কের পরিস্থিতি ও যানবাহনের গতিবিধি না বুঝেই সে একটি ট্রাককে ওভারটেক করতে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
মন্ত্রী জানান, কেয়া পরিবহনের বাসটির ফিটনেস সার্টিফিকেট ও রুট পারমিট হালনাগাদ ছিল না। আর অথৈ পরিবহনের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ভুয়া। নিয়ম ভেঙে তারা ছাদে ৪৪ থেকে ৪৬ যাত্রী তুলেছিল। অথৈ বাসটি দীর্ঘদিন ধরে নাটোর গুরুদাসপর রুটে ভুয়া রেজিষ্ট্রেশন নম্বর প্লেট লাগিয়ে চলাচল করেছে ।
ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ১৭টি সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। সুপারিশগুলোর মধ্যে কাগজপত্র ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান, বাঁক, স্কুল-কলেজ, বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে রিফ্লেক্টিভ ট্রাফিক সাইন স্থাপন, অবৈধ যান চলাচল রোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে শাস্তির
বিধান নিশ্চিত করা, দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত সেবা প্রদানের জন্য জেলা ও হাইওয়ে পুলিশকে অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, এই প্রথম এ ধরনের দুর্ঘটনার পর দ্রুততম সময়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। অতীতে এ ধরনের ঘটনায় তদন্ত রিপোর্ট ডিপফ্রিজে চলে যেত। জানা গেছে, দুর্ঘটনার পরদিন বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ ২৭৯/৩৩৮(ক)/৩০৪ (খ) ও ৪২৭ ধারায় একটি মামলা দায়ের করে। এছাড়া বিআরটিএ আরেকটি মামলা দায়ের করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাস বলেন, কেয়া পরিবহনের চালক আটক রয়েছে। বিষয়টি হাইওয়ে থানার অধীনে। সেখানে যোগাযোগ করলে সঠিক তথ্য জানতে পারবেন বলে জানান তিনি। বনপাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফুয়াদ রুহানী বলেন, আমরা হানিফ পরিবহনের চালকের অস্থায়ী ঠিকানা পেয়েছিলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।
হানিফ পরিবহনের গাড়িটি শনাক্ত করা হয়েছে কি না এই স¤পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো শনাক্ত করা হয়নি। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সেটা চিহ্নিত করা কি এতই কঠিন? প্রশাসন বলছে, হানিফ পরিবহনের ওই বাসটি চিহ্নিত করতে পারেনি তারা। অথচ ওই বাসের একজন যাত্রী ছিলেন নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আতিয়ার রহমান। তিনি জানান ,ঘটনার দিন তিনি সকাল ১১টার দিকে ঢাকার কল্যাণপুর থেকে হানিফ পরিবহনের একটি ছোট বাসে করে টেকনিক্যাল মোড়ে হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে যান। সেখান থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওঠেন ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী হানিফ পরিবহনের বাসটিতে। আতিয়ার রহমান জানান, তিনি সেদিন যে বাসে চেপেছিলেন সেটির সিরিয়াল নম্বর ছিল ৭৪। আর হানিফ পরিবহন এই রুটে তিন শিফটে গাড়ি চালায়। এই বাসটি ছিল সকালের শিফটের শেষ বাস।
সেদিনের দুর্ঘটনাটি কেমন ছিল জানতে চাইলে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন,দ ুই বাসের সংঘর্ষের ঘটনাস্থল থেকে আমাদের বাসটি তখন মাত্র ৪০ গজের মতো দূরত্বে। গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের মতো...ঘটনাস্থল পার হওয়ার সময় মনে হলো, আমাদের বাসটি নিশ্চিত পাশের ধান ক্ষেতের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। মুহূর্তে আমিসহ বাসের সবাই যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম...কিছুক্ষণ পর মনে হলো বাসটি সড়কে উঠে এসেছে। ততক্ষণে আমাদের বাস ধুলা আর গাছের পাতায় ভরে গেছে ।যাত্রীরা চালকের সঙ্গে চেঁচামেচি শুরু করলেন। তখন বাসের সুপারভাইজারের আসনে বসা এক যুবককে বলতে শুনলাম, দুর্ঘটনাস্থল পার হওয়ার সময় আমাদের বাসটি দুর্ঘটনায় হতাহতদের অমানবিকভাবে মাড়িয়ে এসেছে।এ ভাষ্য নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) আতিয়ার রহমানের। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টার গাড়িতে আই-৫ নম্বর আসনে তিনি যাত্রী হিসেবে ওঠেন। গাড়ির নিবন্ধন নম্বর ছিল সম্ভবত ১৫৭৫। কোচ নম্বর ৭৪। বাসটি ছাড়ার পর থেকে খুব দ্রুতগতিতে যাচ্ছিল। চালককে অভিজ্ঞ মনে হওয়ায় যাত্রীরা তাঁকে বাধাও দিচ্ছিলেন না।
আতিয়ার রহমান বলেন, হানিফ পরিবহনের বাসটি দুর্ঘটনাস্থল থেকে কিছুদূর এসে থামানো হয়েছিল একবার। তারপর একটানে নাটোর বাইপাসের পূর্ব প্রান্তে এসে তাকে নামিয়ে দিয়ে রাজশাহী চলে যায়। তিনি ছিলেন, একমাত্র নাটোরের যাত্রী, বাকি সবাই রাজশাহীর। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণকারী ছাত্রছাত্রী ।হতাহতদের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে যাওয়ার কথা তাৎক্ষণিক পুলিশ প্রশাসনকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি? জবাবে এডিসি বলেন, ঘটনার পর থেকে নাটোর বাইপাসে নামা পর্যন্ত নিজের জীবনের কথা ছাড়া আর অন্য কিছুই ভাবতে পারিনি তিনি । এমনকি আমার স্ত্রীকে ফোন করিনি। পরে তদন্ত  কমিটিকে সব বলেছি ।
আতিয়ার রহমানের এই বক্তব্য ধরে হানিফ পরিবহনের গাড়িটি চিহ্নিত করা কোনো ব্যাপারই নয় বলে মনে করেন নিহতদের স্বজনরা। তারা  করেন, প্রশাসন ইচ্ছে করেই এই কাজটি করছে না।আতিয়ার রহমানও মনে করেন, হানিফ পরিবহনের কাউন্টার থেকে গাড়ির চালান জব্দ করলেই তো গাড়ি ও চালককে আটক করা যাবে। কোন কাউন্টার থেকে কোন সময় বাসটি ছেড়ে গিয়েছিল সে তথ্য জানা গেছে। তারপরও বাসটি চিহ্নিত না হওয়ার কারণ কী জানতে বিআরটিএর পরিচালকের (এসফোর্সমেন্ট)  টেলিফোন ০২-৫৮১৫৪৭০১ নম্বরে কল করলে জানানো হয় পরে কল করতে। তবে পরবর্তী সময় কল করা হলেও তা ধরেননি কেউ। এছাড়াও উপপরিচালকের ০২-৫৮১৫৪৭৬২  নম্বরে কল করা হলেও কল রিসিভ হয় নাই।
হানিফ পরিবহনের স্বত্বাধিকারী ও সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ স¤পাদক কফিল উদ্দিন হতাহত ব্যক্তিদের মাড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, এটা মিথ্যা কথা। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে  বলেন, এটা মিথ্যা কথা। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
কেবল নাটোরের দুর্ঘটনা নয়, সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উদাসীনতার অভিযোগ পুরনো। সর্বশেষ নাটোরে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত হানিফ পরিবহনকে রক্ষা করার জন্য দেনদরবার চলছে বলে বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে।
  • 0Blogger Comment
  • Facebook Comment

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন